আল-হাদিস |
প্রিয় শিক্ষার্থীরা, তোমরা পূর্বের শ্রেণিতে হাদিস সর্ম্পকে জেনেছ। তোমরা সেখানে হাদিসের পরিচয়, প্রকারভেদ, গুরুত্ব ও বিশুদ্ধ ৬টি হাদিসগ্রন্থ সম্পর্কে জেনেছ। মানবিকতা ও নৈতিক গুণাবলি সম্পর্কিত এবং মুনাজাতমূলক জীবনঘনিষ্ঠ নির্বাচিত কিছু হাদিস শিখেছ। তোমরা সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে হাদিস সম্পর্কে যা শিখেছ, নবম শ্রেণিতে তার সঙ্গে হাদিস, সুন্নাহ, আসার, হাদিসে কুদসি, মাতরুক, মাওযু হাদিসের পরিচয় ও হাদিসের গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে পারবে। পাশাপাশি নির্বাচিত কিছু হাদিসের শিক্ষা এবং মুনাজাতমূলক জীবনঘনিষ্ঠ হাদিস শিখে বাস্তব আমল করতে পারবে।
হাদিস
হাদিস ( حَدِيث )আরবি শব্দ। এর অর্থ হলো কথা, বক্তৃতা, বাণী, বার্তা, সংবাদ, বিষয় ও খবর ইত্যাদি। সাধারণত রাসুলুল্লাহ (সা.)- এর কথা, কাজ, অনুমোদন ও মৌনসম্মতিকে হাদিস বলে। নবি করিম (সা.) যা কিছু বলেছেন, যা কিছু করেছেন এবং যা কিছু বলার বা করার অনুমতি দিয়েছেন, অথবা সমর্থন জানিয়েছেন, তাকে হাদিস বলা হয়।
সুন্নাহ ( السُّنَّة )
সুন্নাহ শব্দটি হাদিসের সমার্থক শব্দ। সুন্নাহ শব্দের অর্থ পথ, পদ্ধতি, কর্মের নীতি ও আদর্শ। রাসুলুল্লাহ (সা.) যে পথ, পন্থা ও রীতি-পদ্ধতি অবলম্বন করে চলতেন, তাকে সুন্নাহ বলা হয়। অন্য কথায় রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রচারিত আদর্শই সুন্নাহ। কুরআন মাজিদে উত্তম আদর্শ বলতে এই সুন্নাহকেই বুঝানো হয়েছে।
আসার (آثار )
আসার শব্দটির অর্থ চিহ্ন, নিদর্শন ও বস্তুর অবশিষ্ট অংশ। আসার শব্দটিও কখনো কখনো রাসুলুল্লাহ (সা.)- এর হাদিসকে নির্দেশ করে। কিন্তু অনেকেই হাদিস ও আসার এর মধ্যে পার্থক্য করে থাকেন। তাঁদের মতে- সাহাবিগণ থেকে শরি'আত সম্পর্কে যা কিছু উদ্ধৃত হয়েছে, তাকে আসার বলে। কারো কারো মতে, সাহাবি ও তাবেয়িগণের কথা ও কাজ, সমর্থন ও অনুমোদনই হলো আসার।
হাদিসে কুদসি: যে হাদিসের মূল বক্তব্য আল্লাহ তা'আলা সরাসরি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে স্বপ্ন বা ইলহামের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজ ভাষায় তা বর্ণনা করেছেন, তাকে হাদিসে কুদসি বলে। মাতরুক ( مَتْرُوْكْ ): মাতরুক শব্দের আভিধানিক অর্থ পরিত্যক্ত, পরিত্যাজ্য ও বাতিল। যে রাবি সকল মুহাদ্দিসের নিকট দুর্বল, তার বর্ণিত হাদিসকে মাতরুক বলে। অন্য কথায় যে হাদিস কোনো দুর্বল রাবি একা বর্ণনা করেছেন তাই 'মাতরুক' বা পরিত্যক্ত। তার হাদিস 'মারদুদ' বা প্রত্যাখ্যাত।
মাওযু ( مَوْضُوعٌ ) বা জাল হাদিস: মাওযু শব্দের অর্থ জাল, মনগড়া, বানোয়াট, তৈরিকৃত, নির্মিত, মিথ্যা কথা রটনা এবং ভুলভাবে মুহাম্মাদ (সা.)-এর বাণী বর্ণনা করা ইত্যাদি। মহানবি (সা.)-এর উপর বানোয়াট ও রচনাকৃত কথাকেই মাওযু হাদিস বলে। অন্য কথায় যে হাদিসের রাবি জীবনে কখনও ইচ্ছাকৃতভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.)- এর নামে মিথ্যা কথা রটনা করেছেন বলে প্রমাণিত, তার বর্ণিত হাদিসকে মাওযু হাদিস বলে। মোটকথা মহানবি (সা.) এর নামে অসত্যভাবে যে কথা বলা হয়েছে, তা-ই জাল হাদিস।
মাওযু বা জাল হাদিসের হুকুম: জাল হাদিস যেহেতু হাদিস নয়, তাই জাল ও বানোয়াট জানার পরও উক্ত বক্তব্যটিকে রাসুলুল্লাহ (সা.)- এর হাদিস বলে প্রচার করা হারাম। তবে মানুষকে জাল হাদিস চেনানোর জন্য তা বর্ণনা করা জায়েয।
হাদিসের গুরুত্ব
হাদিস মুসলমানদের এক অমূল্য সম্পদ। ইসলামি শরিয়তের দ্বিতীয় উৎস হাদিস। ইসলামি জীবন বিধানের অন্যতম মূলভিত্তি। কুরআন মাজিদের পরই হাদিসের স্থান। কুরআন মাজিদ যেখানে ইসলামি জীবন ব্যবস্থার মূলনীতি পেশ করে, হাদিস সেখানে এ মূলনীতির বিস্তারিত বিশ্লেষণ করে। কুরআন ইসলামের আলোকস্তম্ভ, হাদিস তাঁর বিচ্ছুরিত আলো। কুরআনে আল্লাহ তা'আলা এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে অনুসরণের কথা বলা হয়েছে। কুরআন মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রকাশ্য ওহি। হাদিস অপ্রকাশ্য ওহি। কারণ, রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে কখনও মনগড়া কথা বলেননি। মহান আল্লাহর নির্দেশনা পেয়েই তিনি মানুষকে বিভিন্ন বিষয়ে জানাতেন। মহান আল্লাহ বলেন,
وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى * إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى
অর্থ: এবং তিনি মনগড়া কথা বলেন না। তা তো ওহি, যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ হয়। (সূরা আন-নাজম: ৩-৪)
হাদিসে কুরআনের নির্ভুল ব্যাখ্যার পাশাপাশি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন, কর্ম, ত্যাগ, আদর্শ, ধৈর্য, মানবপ্রেম, আল্লাহর ভয়, সত্যের পথে আপসহীনতা, বিশ্বস্ততা, সততা, নবুওয়াত, হেদায়াত ও উপদেশের বিস্তারিত বিবরণ জানা যায়।
আল কুরআনে 'সব কিছুর' বর্ণনা রয়েছে। সেগুলোর অধিকাংশই 'প্রাথমিক নির্দেশ'। ব্যাখ্যা ছাড়া যেগুলো পালন করা অসম্ভব। মহানবি (সা.) সংক্ষিপ্ত নির্দেশগুলোর প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। যেমন: ইসলামের সর্বোচ্চ ও সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদাত 'সালাত'। কুরআনের অনেক স্থানে সালাতের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কুরআনে সালাতের পদ্ধতি ব্যাখ্যা করা হয়নি। অর্থাৎ 'সালাত' কী, কখন তা আদায় করতে হবে, কখন কত রাকআত আদায় করতে হবে, প্রত্যেক রাকআত কী পদ্ধতিতে আদায় করতে হবে, প্রত্যেক রাকআতে কুরআন পাঠ কীভাবে হবে, রুকু কয়টি হবে, সিজদা কয়টি হবে, কীভাবে রুকু ও সিজদা আদায় করতে হবে। কোনো কিছুই কুরআনে শিক্ষা দেওয়া হয়নি। রাসুলুল্লাহ (সা.) সালাতের বিস্তারিত পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি বলেন,
صَلُّوْا كَمَا رَأَيْتُمُونِي أُصَلِّي فَإِذَا حَضَرَتِ الصَّلُوةُ فَلْيُؤَذِّنْ لَكُمْ أَحَدُكُمْ وَلْيَؤُمَّكُمْ أَكْبَرُكُمْ
অর্থ: তোমরা সালাত আদায় করবে যেভাবে আমাকে সালাত আদায় করতে দেখেছ। সালাতের সময় হলে তোমাদের মধ্যে একজন আযান দেবে। এরপর তোমাদের মধ্যে যে বয়সে বড় সে তোমাদের সালাতের ইমামতি করবে। (বুখারি)
অনুরূপভাবে কুরআনে যাকাত প্রদানের নির্দেশ এসেছে। কিন্তু যাকাত প্রদানের বিস্তারিত নির্দেশনা কুরআনে নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) এগুলোর নিয়ম-কানুন বিস্তারিতভাবে হাদিসের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন। এ কারণেই কুরআনের মতো হাদিসের গুরুত্ব অপরিসীম। মোটকথা একজন মুসলমানের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সমস্ত বিষয়ের বিস্তারিত নির্দেশনা আমরা রাসুলের হাদিসে পেয়ে থাকি। এ জন্য আল্লাহ তা'আলা বলেন,
وَمَا أَتْكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهُكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا
অর্থ: রাসুল তোমাদের যা দেন তা তোমরা গ্রহণ করো এবং যা হতে তোমাদের নিষেধ করেন তা হতে বিরত থাক। (সূরা হাশর, আয়াত : ৭)
আল্লাহর ক্ষমা ও ভালোবাসা লাভের জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আনুগত্য করা একান্ত জরুরি। কেননা, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আনুগত্যের মধ্যেই রয়েছে আল্লাহর আনুগত্য। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, 'বলুন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস তাহলে আমাকে অনুসরণ করো, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করবেন'। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ৩১)
রাসুলুল্লাহ (সা.) মানব জাতির শিক্ষক ছিলেন। আমরা হাদিসের মাধ্যমে মহানবি (সা.)-এর জীবনাদর্শ জানতে পারি। তিনি কেমন ছিলেন, কীভাবে কুরআন লাভ করলেন, কীভাবে তা শিক্ষা দিলেন, কীভাবে সংকলন করলেন ইত্যাদি।
অতএব মানব জীবনে হাদিসের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। হাদিস ছাড়া কোনো অবস্থাতেই কুরআন বোঝা বা ইসলামি জীবন গঠন করা সম্ভব নয়। আবার হাদিসকে অস্বীকার করা কিংবা সন্দেহ পোষণ করা কুফরি। সুতরাং আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হুবহু অনুকরণ করব। হাদিসের ভিত্তিতেই কুরআনের নির্দেশাবলি পালন করব। আর হাদিসের আলোকে জীবন গঠন করব।
Read more